জ্যোতিকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়
গত ১৩ই মে, ২০১১ থেকে রাজ্যে এসেছে তথাকথিত ‘পরিবর্তন’। ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকার এখন স্মরণীয় ইতিহাস। ‘বদলা নয় — বদল চাই’ স্লোগানের ভাঁওতার আড়ালে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস। তারপর অতিক্রান্ত হয়েছে দু’বছর। এই দু’বছরেই পরিবর্তনের বাংলাতে বামপন্থী কর্মীদের শহীদ হবার তালিকা ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। কৃষি সঙ্কটে, ফসলের দাম না পেয়ে এখনও পর্যন্ত ৮৫ জনের বেশি কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। সব থেকে আক্রান্ত সর্বস্তরের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও নারীর মর্যাদা। ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’-র তথ্য অনুযায়ী নারী নির্যাতনে পশ্চিমবাংলা গোটা দেশের শীর্ষে উঠে এসেছে। এ লজ্জা আমরা রাখবো কোথায়! তৃণমূল দল ও তাদের পরিচালিত রাজ্য সরকারের ভূমিকার কারণে পঞ্চায়েত নির্বাচনও পৌঁছেছে এক জটিল আবর্তের গহ্বরে। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জুলাই মাসে পাঁচ দফাতে রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হবার কথা। ঘোর বর্ষা ও রমজান মাসে পঞ্চায়েত ভোটের জন্য দায়ী রাজ্যের তৃণমূল সরকারই। অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েই তারা রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে সব সময় উপেক্ষা করেছে ও অযথা কালক্ষেপ করেছে। বর্তমান সময়ের সঙ্গে কি আশ্চর্য মিল গত শতাব্দীর সন্ত্রাস কবলিত কুখ্যাত সত্তর দশকের। এ যেন অতীতের আয়নায় বর্তমানকে ফিরে দেখা।
সেদিনও ছিল এমন সন্ত্রাস কবলিত রক্তঝরা দিন। গত শতকের সেই কালো অন্ধকারময় সত্তরের দশক। ১৯৭২ সালের কুখ্যাত জালিয়াতি নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে পদদলিত করে রাজ্যে ক্ষমতায় আসীন ‘রিগিং মাস্টার’ প্রয়াত সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেসের সরকার। মানুষের কথা বলার অধিকারও কার্যত নেই। রাজ্যজুড়ে চলছে আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস। এক দমবন্ধ করা পরিবেশ। বামপন্থী কর্মীরা খুন হচ্ছেন। তাঁদের জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মিথ্যা মামলায়। হাজার হাজার সি পি আই (এম) সংগঠক, কর্মী ও সমর্থকরা ঘরছাড়া, এলাকাছাড়া। ‘ইন্দিরা গান্ধী যুগ যুগ জীও’ স্লোগান দিয়ে দখল হয়ে যাচ্ছে কলেজের ছাত্র সংসদ থেকে কারখানাতে ট্রেড ইউনিয়ন অফিস। বর্তমানে যা চলছে রাজ্যে — সেদিন ছিল ঠিক তেমনই অন্ধকার সময়।
তখন পৌর এলাকা বা শহরাঞ্চলে বিধিবদ্ধ বা পূর্ণ রেশনিং এলাকায় রেশনের নামে সরবরাহ করা নামমাত্র অখাদ্য-কুখাদ্যই ছিল জনগণের সম্বল বা ভরসা। তখন সরকার চালু করেছিলেন চালের ‘কর্ডনিং’ ব্যবস্থা। গ্রামাঞ্চল থেকে চাল আনা ছিল আইনি মতেই নিষিদ্ধ কাজ। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়েও নিতান্ত পেটের দায়ে এই নিষিদ্ধ কাজই করতেন গরিব শ্রমজীবী মানুষেরা। একাজে যুক্ত থাকতেন বাস্তুহারা কলোনির গরিব মহিলারাও। তথাকথিত বেআইনি পথে এঁদের আনা চালই তখন অন্নের প্রধান ভরসা জোগাতো কলকাতা ও মফস্বল শহরাঞ্চলের নাগরিকদের। কারণ রেশনে সরবরাহ করা সাপ্তাহিক বরাদ্দের চালে একজন ব্যক্তির সাধারণভাবে সাতদিন চলতো না। আর বেশিরভাগ সময় রেশনের চাল থাকতো মানুষের খাবার অযোগ্য। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার পরিবেশও তখন ছিল না। চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের বিখ্যাত ছবি ‘কলকাতা-৭১’-এ এই অবস্থার বর্ণনা তুলে ধরা আছে।
১৯৭৩ সালের ৭ই জুলাই। হিন্দমোটর কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের সেদিন বেতন হয়েছে। দুপুরে প্রথম শিফটের ছুটির পর হিন্দমোটর রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে তখন শ্রমিক-কর্মচারীদের থিকথিকে ভিড়। কারখানার শ্রমিকদের চোখের সামনে তদানীন্তন কংগ্রেস সরকারের সশস্ত্র পুলিসবাহিনী অসহায় নিরস্ত্র মহিলা চাল বিক্রেতা (পুলিসের ভাষায় চালের চোরাকারবারী!) মা-বোনেদের সম্ভ্রম ও ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু করতেই প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল সেদিনের শ্রমিকশ্রেণী। বেপরোয়া পুলিসবাহিনী অবস্থার মোকাবিলা করার জন্য একতরফাভাবে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করা শুরু করে। পুলিসের গুলিতে হিন্দমোটরের চারজন শ্রমিক প্রাণ হারান। তদানীন্তন কংগ্রেস সরকারের বর্বরতার শিকার হন হিন্দমোটর কারখানার শ্রমিকরা। গরিব ঘরের মহিলাদের পুলিসের হাতে ইজ্জত ও সম্ভ্রমহানি হতে দেখে প্রতিবাদ করার ফল মেলে হাতে হাতে। পুলিসের গুলিতে শহীদের মৃত্যুবরণ করেন হিন্দমোটর কারখানার তারাপদ মণ্ডল, পুরুষোত্তম সাউ, এনায়েত বসির ও দিলীপ লাহা। পুলিসের নির্মম গুলি শ্রমিকশ্রেণীর জাত ধর্ম ভাষা ও সমস্তরকম ভেদাভেদকে মুছে দেয়। কারণ নিহত চারজনের মধ্যে উল্লিখিত প্রথম তিনজন ছিলেন সি আই টি ইউ অনুমোদিত হিন্দুস্তান মোটরস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সদস্য এবং শেষোক্ত জন যুক্ত ছিলেন আই এন টি ইউ সি-র সাথে। এছাড়াও পুলিসের গুলি চালনায় সেদিন গুরুতর আহত হয়েছিলেন হিন্দমোটরের ফাউন্ড্রির শ্রমিক এস এন পাল।
নারীর সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে পুলিসের গুলিতে শ্রমিকশ্রেণীর আত্মবলিদানের এই ঘটনা সেদিনের রাজ্যের দমবন্ধ করা আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসকে ভেঙে দিয়ে গর্জে ওঠার সাহস জোগাতে সাহায্য করে। সেদিন টেলি-মিডিয়া ছিল না, কিন্তু এই বর্বরোচিত নারকীয় ঘটনার সাথে সাথে ঐ দিনই হিন্দমোটর কারখানার সমস্ত শ্রমিক-কর্মচারীরা সি আই টি ইউ-র আহ্বানে কারখানাতে ধর্মঘট করেন। এই ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন ৮ই জুলাই, ১৯৭৩ সমগ্র উত্তরপাড়া থানা এলাকায় বন্ধ এবং ৯ই জুলাই, ১৯৭৩ হুগলী জেলা বন্ধ ডাকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী), হুগলী জেলা কমিটি। কংগ্রেসী মস্তানবাহিনী ও পুলিসের জুলুম উপেক্ষা করে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়ায় ও বিক্ষোভ প্রতিবাদে বন্ধগুলি সফল হয়। ১৯৭২ সালের জালিয়াতি নির্বাচনের পর সারা রাজ্যের শ্বাসরোধকারী অবস্থার প্রতিবাদে, হিন্দমোটরে পুলিসের গুলিতে শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনার পরপরই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ও অন্যান্য বামপন্থী দলগুলির ডাকে ২৭শে জুলাই, ১৯৭৩ পালিত হয় বাংলা বন্ধ। হিন্দমোটরের শ্রমিকশ্রেণীর এই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম সেদিন গোটা রাজ্যের গণ-আন্দোলনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
হিন্দমোটরে পুলিসের গুলি চালনার তদন্ত করতে জনগণের আন্দোলনের চাপে ও দাবিতে তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার ‘বর্মণ কমিশন’ গঠন করতে বাধ্য হয়েছিল। তার আগে পুলিস হিন্দমোটর স্টেশন লাগোয়া বটতলা বাজার এলাকার স্থানীয় যুবকদের ও সাধারণ দোকানদারদের মিথ্যা অভিযোগে, তদানীন্তন কংগ্রেসী মস্তানবাহিনীর নির্দেশে, গ্রেপ্তার করেছিল। গ্রেপ্তার করেছিল সেই সময়ের সি পি আই (এম) এবং সি আই টি ইউ কর্মীদের। বর্মণ কমিশনে সাক্ষ্য দেবার জন্য যাঁরা প্রস্তুত হচ্ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সি আই টি ইউ নেতা সন্তোষ দেব, মুকুল বৈশ্য, রবিকুমার পাল (কাল্টু), মনন চৌধুরী, দেবীপ্রসাদ বসুরায়, দিলীপ ঘোষ প্রমুখ। সাক্ষী দেওয়ার আগেই সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিসবাহিনী এঁদের মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। এই গ্রেপ্তারের পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দুস্থান মোটরস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সম্পাদক ও তদানীন্তন সাংসদ কমরেড দীনেন ভট্টাচার্য ঘোষণা করেছিলেন, ‘বর্মণ কমিশন’ প্রহসনে পরিণত হবে, তাই ঐ কমিশন বয়কট করা হয়।
পুলিসের গুলিতে শ্রমিকের শহীদ হওয়ার, গণ-আন্দোলনের এই ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে সি আই টি ইউ অনুমোদিত হিন্দুস্থান মোটরস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের উদ্যোগে হিন্দমোটর রেল স্টেশনের পাশে বটতলা বাজারে ১৯৭৪ সালের ৭ই জুলাই নির্মাণ করা হয় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। এই শহীদবেদী নির্মাণ করার সময়ও এলাকার কংগ্রেসী গুণ্ডাবাহিনী বাধা দিতে এসেছিল এবং শৈলেন চৌধুরী (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর অন্যতম সংগঠক), কল্যাণব্রত পাল প্রমুখ সি পি আই (এম) কর্মীরা আক্রান্ত হয়েছিলেন। শহীদবেদী তৈরিতে বাধা দিচ্ছে কুখ্যাত কংগ্রেসী মস্তানের দল — এই খবর মুখে মুখে চাউর হতেই জনতা সরণিতে অবস্থিত হিন্দমোটর ইউনিয়ন অফিস (বর্তমান দীনেন স্মৃতি ভবন) থেকে তদানীন্তন সি আই টি ইউ নেতা সুনীল দেবসহ অন্যান্যরা দলে দলে বেদী নির্মাণস্থলে ছুটে আসেন। জড়ো হয়ে যান এলাকার সি পি আই (এম) কর্মীরাও। কংগ্রেসীদের বাধার মোকাবিলা করেই সেদিন নিহত শ্রমিকদের শহীদবেদীটি নির্মিত হয়। ১৯৭৪ সালের ৭ই জুলাই এই শহীদবেদীটি উদ্বোধন করেছিলেন প্রয়াত জননেতা কমরেড জ্যোতি বসু। গত ২০১০ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) কোতরং আঞ্চলিক কমিটি পুরানো শহীদবেদীটি সংস্কার করে নবরূপে তা নির্মাণ করে। প্রতিবছর সি আই টি ইউ এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র উদ্যোগে হিন্দমোটর কারখানার শ্রমিকদের রক্তস্নাত ৭ই জুলাই, ১৯৭৩ দিনটিকে স্মরণ করা হয় শহীদ স্মরণসভার মাধ্যমে।
এবছরও ৭ই জুলাই, ২০১৩, রবিবার বিকাল ৫টায় হিন্দমোটর স্টেশনের বটতলা বিদ্যাসাগর বাজার সংলগ্ন স্থানে শ্রমিকদের স্মরণে নির্মিত সেই ঐতিহাসিক শহীদবেদীর সামনে বিকাল ৫টায় রক্তস্নাত ৭ই জুলাইকে স্মরণ করা হবে স্মরণসভার মাধ্যমে। এই সভার মাধ্যমে গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের কালো দিনগুলিকে স্মরণ করার পাশাপাশি অতীতের আয়নায় বর্তমানকেও আমরা ফিরে দেখতে চাই। অতীতের সেই কংগ্রেসের গর্ভজাত বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত পশ্চিমবাংলায় যে ভয়ানক দুর্বৃত্তরাজ, জুলুম, অত্যাচার, নারী নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ, মিথ্যা মামলা, ছাত্র সংসদ দখল, ট্রেড ইউনিয়ন দখল, স্কুল কমিটি — সমবায় দখল, হাজার হাজার বামপন্থী কর্মীদের এলাকা ছাড়া করা ও জরিমানা দিতে বাধ্য করা, মানুষের সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা এবং তৃণমূলী রাজ্য সরকারের লাগামছাড়া কদর্য মিথ্যাচার ও জুলুম চলছে — আমরা তাকেও ধিক্কার জানাতে চাই। আমাদের বিশ্বাস — একজন সংবেদনশীল গণতন্ত্রপ্রিয় প্রতিবাদী মানুষ হিসাবে আমরা আপনাকে পাশে পাবো। শ্রমিকের রক্তস্নাত ৭ই জুলাই, ১৯৭৩ স্মরণে সমবেত হয়ে আসুন শপথ গ্রহণ করি, বর্তমান তৃণমূলী অপশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের সংঘবদ্ধ প্রতিবাদই হোক এই দমবন্ধ করা সময় থেকে বের হবার রাস্তা। কারণ সংঘবদ্ধ মানুষই পারে সমস্ত অন্যায়কে রুখে দিতে।
- See more at: http://ganashakti.com/bengali/news_details.php?newsid=43264#sthash.EnHlBvfA.dpuf
No comments:
Post a Comment